আজ ২৪শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ই মে, ২০২৪ ইং

দূষণ ও ভরাটে জর্জরিত কোহেলীয়া নদী , মাছের অকালে জেলেদের মাথায় হাত

আবু বক্কর ছিদ্দিক , মহেশখালী প্রতিনিধি :

পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেমন রক্ত প্রবাহ জরুরি তেমনি বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে এদেশের বুকের ভেতর নদী প্রবাহ জরুরি । ইতিহাসের সুদূর আদিকাল থেকেই বাংলাদেশ শস্য-শ্যামলা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর হবার কারন হল এই দেশ নদীবিধৌত পলি ভূমি দ্বারা গঠিত একটি বদ্বীপ ।

তার মূলে রয়েছে নদ-নদীর অবদান । নদীই বাংলাদেশের প্রাণ । সে বৈশিষ্ট থেকে বাইরে ছিল না কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর কোহেলিয়া নদী । মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া, মাতারবাড়ী-ধলঘাটা ইউনিয়নের মাঝখানে অবস্থিত কোহেলিয়া নদী ।

আদিকাল থেকে যুগ যুগ ধরে জোয়ার-ভাটায় আপন গতিতে ভরা যৌবনে প্রবাহিত হত কোহেলিয়া নদীর স্রোত । সাম্প্রতিক সময়ে মাতারবাড়ী নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বর্জ্য পাইপের মাধ্যমে ফেলা হচ্ছে কোহেলীয়া নদীতে ।

কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারনে কোহেলিয়া নদী এখন মৃত প্রায় । সময়ের পরিক্রমায় ডিজিটাল আইল্যান্ড মহেশখালীর ঐতিহ্যবাহী পুরানো এই কোহেলিয়া নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে ।

মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য মাতারবাড়ীর দক্ষিণে ১৪’শ ১৪ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে বর্তমানে সেখানে মাটি ভরাট করে প্রকল্পের অবকাঠামো কাজ চলছে দ্রুতগতিতে ।

এখন প্রায় ৮০% সম্পন্ন হয়েছে প্রকল্পের কাজ । প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য সড়ক নির্মাণের নামে নদীর একটি বিরাট অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে । তার উপর সম্প্রতি চলমান প্রকল্পের বিভিন্ন দুষিত বর্জ্য ও পলি মাটি গুলো পাইপের মাধ্যমে সরাসরি কোহেলিয়া নদীতে ফেলা হচ্ছে ।

প্রকল্পে নির্মাণ কাজের জন্য ব্যবহ্নর বিভিন্ন কেমিকেল মিশ্রিত বর্জ্য পলি মাটির সাথে মিশে নদীর পানির রং পাল্টে গেছে । যেভাবে নদীর পানি দূষিত হয়েছে তাতে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণি বাসকরাও দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে । জেলেরা জাল নিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে মাছ না পেয়ে খালি হাতে ঘরে ফিরতে হচ্ছে ।

অপরদিকে কোহেলিয়া নদীর পানি দিয়ে লবন উৎপাদনকারী চাষিরাও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন । অনেক লবন চাষিগন এ দুষিত পানি দিয়ে লবন উৎপাদন ব্যাহত হবে বলেও মনে করেন । প্রকল্পের বর্জ্য মিশ্রিত পলি মাটি যেমন নদীর পানি দূষিত হচ্ছে একই ভাবে এ পলি মাটির দ্বারা দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীও ।

এতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে মারাত্মক ভাবে । নদী ভরাটের কারনে নদীর উপর চলাচল কারী ইঞ্জিনচালিত লবণের বোট ও বিভিন্ন ধরনের নৌ-যান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দিয়েছে ।

তাই বেকার হয়েছে এসব নৌ-যান এর মালিক সহ মাঝিমাল্লা ও শ্রমিকগন । অপর দিকে নদীর পানি দূষিত হওয়ায় সামুদ্রিক মাছ সহ মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী । এতে বেকারত্ব জীবনযাপন করছে এ নদীর উপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার জেলে ।

স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন , মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে এখনো দূষিত কয়লা ব্যবহার করা হচ্ছে না । কয়লা ব্যবহারের আগেই প্রকল্পের বর্জ্য গুলো যেভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে , প্রকল্পের কাজ শেষে কয়লা পুড়ানো হলে আশেপাশের নদী ও সমুদ্রের পানি দূষণে ভয়াবহ আকার ধারন করবে এমনটি মনে করেন তারা ।

নদীতে মাছ আহরণকারী স্থানীয় জেলে নুরুল কাদের বলেন , আগে এনদীতে জাল বসালে দৈনিক ২/৩ হাজার টাকা মাছ বিক্রি করে পেতাম । আর এখন দু’শ টাকার মাছও পাওয়া যায়না । নদীতে জাল বসালে মাছের বদলে পলি মাটি ঢুকে জাল আটকে যায় ।

এভাবে মাছ না পেলে আমাদের সংসারের খরচ যোগাব কিভাবে? নদীর পানি যেভাবে দূষিত হয়েছে তাতে মাছতো দুরের কথা অন্যান্য জলজ প্রাণি বসবাসেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে ।

মাছ না পাওয়ায় কোহেলিয়া নদীর অনেক জেলে এখন বেকার হয়ে পড়েছে । ভবিষ্যতে সংসারের খরচ যোগাতে আমরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি । মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের নাম দিয়ে কোহেলিয়া নদী ভরাট করে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে ।

একই সাথে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পলি মাটি ও বিভিন্ন বর্জ্য নদীর সাথে মিশে পানি ঘোলাটে ও দূষিত হচ্ছে । যার কারণে একদিকে যেমন নদী ভরাট হচ্ছে , অন্যদিকে দখলের কারনে ছোট হয়ে যাচ্ছে এ নদী । এভাবে দূষণ ছড়াতে থাকলে মারাত্মকভাবে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে ।

এমন কি এসব এলাকার মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগব্যাধি দেখা দিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন পরিবেশবাদিরা । পৃথিবীর কোনো দেশে এভাবে নদী দূষণ করে উন্নয়ন করা হচ্ছে না ।

নদী ভারাট ও দূষণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা । কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পলি মাটি নদীর পানির সাথে মিশে গিয়ে বর্তমানে নদীর পানি ঘোলাটে এবং দূষিত হওয়ায় নদীর দু’পাশে প্রায় অর্ধশত চিংড়ি প্রজেক্টে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে মাছের পোনা সহ নানা প্রজাতীর মাছ মারা যাচ্ছে ।

এ কারণে চিংড়ি প্রজেক্টের ইজারাদারগন প্রতি বর্ষা মৌসুমে শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয় । তাই অনতিবিলম্বে কোহেলীয়া নদীর উপর দূষিত বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা সহ অবৈধ দখলদারের হাত থেকে কোহেলীয়া নদী উদ্ধারের দাবী জানান মহেশখালীবাসি ।

Comments are closed.

     এই বিভাগের আরও সংবাদ